চিংড়ি অত্যন্ত পচনশীল জীব। সাধারণত চিংড়ি ধরার ৩ থেকে ৫ ঘন্টার মধ্যেই চিংড়ির পচনক্রিয়া শুরু হয়। সেজন্য আহরণকৃত চিংড়ি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাজারজাত করা উচিত। তবে চিংড়ি ধরার পরে বাজারজাতকরণের পূর্ব মুহুর্ত পর্যন্ত চিংড়ির গুণগতমান বজায় রাখার জন্য নিম্নে উল্লিখিত পদক্ষেপসমূহ ধারাবাহিকভাবে অনুসরণ করা যেতে পারে-
সাধারণ অর্থে বেশি সময়ের জন্য চিংড়ি সংরক্ষণকে প্রক্রিয়াজাতকরণ বলা হয়। এ পদ্ধতিতে গুণগত ও অবস্থানগত গঠনের কোনো পরিবর্তন হয় না। ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে প্রক্রিয়াজাত করা গুণগত মানসমৃদ্ধ চিংড়ি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করা হয়। চিংড়ি প্রক্রিয়াজাতকরণের বিভিন্ন পদ্ধতি নিম্নে বর্ণনা করা হলো-
ক. ভাজা বা অবিকৃত অবস্থায় সংরক্ষণ
চিংড়ির মৃত্যুর পর প্রধানত দু'টি কারণে চিংড়ি নষ্ট হয়ে থাকে, যেমন- রাসায়নিক বিক্রিয়ার কারণে নষ্ট হওয়া ও ব্যাক্টেরিয়া বা জীবাণুর আক্রমণে নষ্ট হওয়া। রাসায়নিক দৃষ্টিকোণ থেকে চিংড়ির মৃত্যুর পর দেহের কোষ থেকে অ্যামাইনো এসিড নিঃসৃত হয়। ফলে চিংড়ির খাদ্যগুণ ও স্বাদ বিনষ্ট হয় এবং ওজন হ্রাস পায়। অপরদিকে ব্যাক্টেরিয়া বা জীবাণুর আক্রমণে চিংড়ির মাংসল অংশে এনজাইমের জলায়ন (hydrolysis ) ক্রিয়ার সাহায্যে নানা ধরনের ফ্যাটি এসিড নিঃসৃত হয়, যা স্বজারণ পদ্ধতিতে (auto oxidation) কার্বনিল যৌগ উৎপন্ন করে, ফলে মাংসল অংশের পচনক্রিয়া শুরু হয় ও দুর্গন্ধযুক্ত হয়। এ কারণেই চিংড়ি ধরার ৫ থেকে ৬ ঘন্টার মধ্যে চিংড়ির প্রক্রিয়াজাতকরণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা উচিত।
রফের সাহায্যে দীর্ঘ মেয়াদে চিংড়ি সংরক্ষণের ক্ষেত্রে চিংড়ি ও বরফের অনুপাত ১:১ (ওজনে) হওয়া বাঞ্ছনীয়। প্রক্রিয়াজাতকরণের কাজে বরফ ব্যবহারের ক্ষেত্রে বরফের টুকরো অত্যন্ত ছোট বা পাতলা আবরণের মত হওয়া উচিত। অনেক সময় ব্যাক্টেরিয়াযুক্ত অপরিশোধিত পানি দিয়ে তৈরি বরফ ব্যবহার বা ব্যাক্টেরিয়াযুক্ত পাত্র ব্যবহারে চিংড়ির মান নষ্ট হতে পারে। এ ক্ষেত্রে চিংড়ি প্রক্রিয়াজাতকরণে ক্লোরিন মিশ্রিত পরিশোধিত পানির সাহায্যে তৈরি বরফ ব্যবহার করা উচিত এবং চিংড়ি সংরক্ষণে ও পরিবহণে ব্যবহৃত সকল প্রকার প্রয়োজনীয় উপকরণসমূহ ক্লোরিন মিশ্রিত পানি (৫ থেকে ১০ পিপিএম) দিয়ে ধোয়া উচিত। এ প্রক্রিয়ায় সংরক্ষিত চিংড়ির ব্যাক্টেরিয়া দ্বারা আক্রমণের সম্ভাবনা কম থাকে। চিংড়ি দীর্ঘকালীন সময়ের জন্য সংরক্ষণে সমুদ্রের পরিষ্কার লোনা পানি ০ থেকে ১ ডিগ্রি সে. তাপমাত্রায় ব্যবহার করে ভাল ফল পাওয়া যায়। অনেক সময় গ্লুকোজ সিরাপ বা কর্ন সিরাপ প্রয়োগ করে তাপমাত্রা আরো কমানো হয়। এ ধরনের সংরক্ষণ পদ্ধতিতে চিংড়ির আকার অপরিবর্তিত থাকে এবং খরচও অপেক্ষাকৃত কম হয়।
বর্তমান বিশ্বের বিভিন্ন দেশে জেট ফ্রিজিং পদ্ধতিতে চিংড়ি সংরক্ষণ করা হয়। এ পদ্ধতিতে ক্রায়োজেনিক নাইট্রোজেন (cryogenic nitrogen) মাইনাস ৩২ ডিগ্রি ফারেনহাইট তাপমাত্রায় মাল্টিজুম (multi- (zoom) ফ্রিজারের মাধ্যমে প্রতি মিনিটে সাত হাজার ফুট হারে সঞ্চালিত করা হয়। ফলে ঠান্ডা জমানো হাওয়া এক মিনিটেরও কম সময়ের মধ্যে চিংড়ি কোষের মধ্যে সঞ্চালিত হয় এবং অতি দ্রুত চিংড়ি সংরক্ষিত হয়।
খ. সিদ্ধ করা
এ পদ্ধতিতে প্রতি পাউন্ডে ১০০ টির অধিক সংখ্যক চিংড়ি লবণ জলে সিদ্ধ করা হয় এবং পরে ফ্রিজে সংরক্ষণ করা হয়। এ প্রক্রিয়ায় এক সাথে বেশ কিছু পরিমাণ চিংড়ি বড় তারের ঝুড়িতে রেখে সেগুলো ফুটন্ত ব্রাইন বা লোনা জলে ১ থেকে ২ মিনিট সিদ্ধ করা হয় এবং পরে তারের পাত্রটি তুলে কোন বড় তারের জালের উপর ভালভাবে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। ফলে অতি দ্রুত সেগুলো ঠান্ডা হয়। এ প্রক্রিয়াকে ব্লাঞ্চিং (blanching) বলা হয়। ব্লাঞ্চিংকৃত চিংড়িগুলো অল্প সময়ের জন্য ২০ ডিগ্রি সে. তাপমাত্রায় ঠান্ডা জলে ডুবানো হয়। এ প্রক্রিয়াকে গ্লেজিং (glazing) বলা হয়।
গ. কৌটাজাতকরণ
মৎস্যসম্পদ সংরক্ষণে কৌটাজাতকরণ একটি প্রচলিত ও প্রাচীন প্রথা। এ প্রক্রিয়ায় ঠান্ডা করা চিংড়ি ব্রাইন বা লবণাক্ত পানি সহযোগে বায়ু নিরোধক পাত্র বা ক্যানে আবদ্ধ করে রপ্তানি করা হয়। ক্যান বা আবদ্ধ পাত্রে চিংড়ির গুণগতমান অবিকৃত রাখার উদ্দেশ্যে লবণপানিতে সাইট্রিক এসিড (০.২%) মিশানো হয়। এ সময়ে দ্রবণের পিএইচ (pH) এর মান ৬.৪ হয়ে থাকে। ক্যানগুলো পরবর্তী ধাপে প্রতি বর্গ সেন্টিমিটারে ০.৭ কিলোগ্রাম ব্যাসযোগে ও ১১৫.৩ ডিগ্রি সে. তাপমাত্রায় ১৮-২০ মিনিট প্রক্রিয়াকরণ করা হয়। কৌটাজাতকরণের ক্ষেত্রে লোহা বা তামার তৈরি ক্যান পরিহার করা উচিত। আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখার উদ্দেশ্যে কৌটাজাতকরণ প্রক্রিয়ায় বা লবণাক্ত পানিতে প্রতি কিলোগ্রাম চিংড়ির জন্য ২৫০ মিলিগ্রাম ডাইসোডিয়াম যৌগ ব্যবহার করা হয়। এ প্রক্রিয়ায় প্রক্রিয়াজাতকৃত চিংড়ি বা মাছ বিভিন্ন অবস্থায় রপ্তানি করা হয়, যেমন- মস্তকবিহীন, সম্পূর্ণ খোসা ছড়ানো, লেজ ছাড়া বাকী অংশের খোলস ছড়ানো, প্রভৃতি। মস্তকবিহীন চিংড়ি গ্রেড অনুসারে প্যাকিং করা হয়।
গ্রেড: গ্রেড হলো প্রতি পাউন্ড চিংড়িতে কত সংখ্যক চিংড়ি বিদ্যামান। যেমন- গ্রেভ ইউ-৫ এর অর্থ হলো প্রতি পাউন্ডে ৫টি বা তার কম সংখ্যক চিংড়ি বিদ্যমান। রপ্তানির ক্ষেত্রে চিংড়ির প্রচলিত গ্রেডগুলো হলো ইউ-১০, ইউ-১১ থেকে ইউ-১৫, ইউ-১৬ থেকে ইউ-২০, ইউ-২১ থেকে ইউ-২৫, ইত্যাদি |
সাধারণ অর্থে প্রক্রিয়াজাতকরণ বলতে বৈজ্ঞানিক উপায়ে চিংড়িকে দীর্ঘসময় গুণগত মানসম্পন্ন অবস্থায় সংরক্ষণ প্রক্রিয়াকে বোঝানো হয়। চিংড়ি সুষ্ঠু বিপণনের ক্ষেত্রে চিংড়ি প্রক্রিয়াজাতকরণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মূলত চিংড়ি প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে চিংড়ি নষ্ট বা পচে যাওয়ার উৎপাদকসমূহ বিশেষ করে জ্যামাইনো অ্যাসিডের ক্রিয়া, ব্যাক্টেরিয়া ও অন্যান্য ক্ষতিকর জীবাণুর আক্রমণ রোধ করা হয় এবং চিংড়ি সম্পদকে অবিকৃত অবস্থায় বিপণনের জন্য দীর্ঘ সময়ের জন্য সংরক্ষণ করা হয়। ব্যবসায়িকভাবে প্রক্রিয়াজাতকৃত চিংড়ি বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করা হয় এবং দূরত্ব নির্বিশেষে অভ্যন্তরীণ চাহিদা পুরণের জন্য বাজারজাত করা হয়ে থাকে। চিংড়ি প্রক্রিয়াজাতকরণের ক্ষেত্রে প্রধানত ৪টি ধাপ অনুসরণ করা হয়। উদ্দেশ্যগত দিক থেকে এ চারটি ধাপ অনুসরণের মাধ্যমে চিংড়ি জীবাণুমুক্ত করে সংরক্ষণ করা হয়। চিংড়ি প্রক্রিয়াজাতকরণের ধাপসমূহ নিচে উল্লেখ করা হলো।
ক. আহরণোত্তর চিংড়ি প্রক্রিয়াজাতকরণের উপযোগীকরণ
চিংড়ি প্রক্রিয়াজাতকরণের প্রথম ধাপ হলো তাজা বা টাটকা চিংড়ি সংগ্রহ করে মাথা ছাড়ানো। সাধারণত প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানায় চিংড়ি নিয়ে আসার পূর্বেই ফড়িয়া বা বেপারি বা আড়তদারগণ চিংড়ির মাথা ছাড়িয়ে ফেলে। সরাসরি খামার বা বাজার থেকে প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানায় আস্ত চিংড়ি আদান-প্রদানের ক্ষেত্রে প্রক্রিয়াজাত কারখানায়ও চিংড়ির মাথা ছাড়ানো হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে চিংড়ি পরিবহণ ও সাময়িক সংরক্ষণের ক্ষেত্রে বরফ সমৃদ্ধ গাড়ী বা পরিবহণ ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
মাথা ছাড়ানোর উদ্দেশ্য হলো চিংড়ির মৃত্যুর পর মাথা সর্বপ্রথম ব্যাক্টেরিয়া দ্বারা আক্রান্ত হয়, কেননা চিংড়ির মাথা ও তার কলাসমূহ মাংসপেশীর চেয়ে অধিক নরম। ফলে মাথা দ্রুত ব্যাক্টেরিয়া দিয়ে আক্রান্ত হয়। এছাড়াও চিংড়ি দেহের গঠনগত কারণে পরিবেশ থেকেই মাথার খোলসের মধ্যে কোন না কোন ধরনের ব্যাক্টেরিয়া বিদ্যমান থাকে। সেগুলো চিংড়ির মৃত্যুর পর পরই অধিক সক্রিয় হয়ে উঠে এবং চিংড়ির পচনক্রিয়া শুরু হয়।
খ. জীবাণুমুক্ত করা ও পচন রোধ করা
বরফে সংরক্ষণ করা: মাথা ছাড়ানোর পর চিংড়ি লেজসহ বাঁশ, কাঠ বা প্লাস্টিকের তৈরি ক্রেটস বা বাক্সের মধ্যে বরফ দিয়ে সংরক্ষণ করা হয়। উদ্দেশ্যগত দিক থেকে এ প্রক্রিয়ায় চিংড়ি ব্যাক্টেরিয়া মুক্ত থাকে এবং পচনক্রিয়া সংগঠিত হতে পারে না। বরফ দিয়ে চিংড়ি সংরক্ষণের ক্ষেত্রে চিংড়ি ও বরফের অনুপাত ১:১ রাখা হয়। সাধারণত বাজার থেকে বা নির্দিষ্ট এলাকা থেকে চিংড়ি সংগ্রহকারীরা এভাবে চিংড়ি সাময়িক সংরক্ষণ করে ২-৩ দিন পর পর প্রক্রিয়াজাত কারখানায় সরবরাহ করে থাকে।
মাথা ছাড়ানো চিংড়ি পরিষ্কার পানিতে ধৌত করা: চিংড়ি প্রক্রিয়াজাত কারখানায় পৌঁছানোর পর মাথা ছাড়ানো বরফ সমৃদ্ধ চিংড়িকে ছিদ্রযুক্ত টেবিলের উপর রাখা হয় এবং পরিষ্কার পানি দিয়ে ধোয়া হয়। চিংড়ি ধোয়ার কাজে প্রধানত গভীর নলকুপের পানি ব্যবহার করা হয়। উল্লেখ্য চিংড়ির পরিষ্কার বা ধোয়ার কাজটি যাতে দ্রুত শেষ করা সম্ভব হয়, সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হয়।
চিংড়ি বাছাই ও ওজন করা: পরিষ্কার পানিতে চিংড়ি ধোয়ার পর গ্রেড অনুযায়ী চিংড়ি বাছাই ও ওজন করা হয়। চিংড়ি বাছাই-এর ক্ষেত্রে চিংড়ির গুণগতমান যথার্থ রয়েছে কী না তা পরীক্ষা করে নেয়া হয়। চিংড়ির গ্রেড নির্ধারণের পদ্ধতি নিচে উল্লেখ করা হলো-
ক্রম | মাথাবিহীন অবস্থায় প্রতি পাউন্ডে চিংড়ির সংখ্যা |
---|---|
১ | ১ থেকে ২০ |
২ | ২১ থেকে ৩০ |
৩ | ৩১ থেকে ৫০ |
৪ | ৫১ থেকে ৭০ |
উল্লেখ্য চিংড়ির গুণগতমান যথার্থ থাকা সত্ত্বেও যদি চিংড়ির খোলস ভেঙে যায় বা খোলসের রঙের পরিবর্তন হয়, তাহলে বাছাই করার সময় এ ধরনের চিংড়ি বাদ দেয়া হয়, যা পিএন্ডডি নামে অভিহিত।
ঠান্ডা ঘরে সংরক্ষণ: চিংড়ি প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানায় চিংড়ির গুণগতমান অক্ষুন্ন রাখার জন্য বাছাইকৃত চিংড়ি প্রক্রিয়াজাতকরণের পরবর্তী ধাপে যাওয়ার পূর্বে ০ (জিরো) ডিগ্রি সে. তাপমাত্রায় নিয়ন্ত্রিত ঘরে রাখা হয়। প্রক্রিয়াজাত কারখানায় এ ধরনের সাময়িক সংরক্ষণ ঘরকে চিল কক্ষ বলা হয়। চিংড়ি আহরণের উৎসের ওপর ভিত্তি করে এ ধরনের কক্ষে ৩টি প্রকোষ্ঠ থাকে-
১) স্বাদুপানির চিংড়ি সংরক্ষণ কক্ষ (গলদা চিংড়ি)
২) লোনাপানির চিংড়ি সংরক্ষণ কক্ষ (মূলত বাগদা চিংড়ি)
৩) লোনাপানির অন্যান্য চিংড়ি সংরক্ষণ কক্ষ
উল্লেখ্য, গলদা চিংড়ি সংরক্ষণের ক্ষেত্রে স্বাদুপানির বরফ এবং লোনাপানির চিংড়ি সংরক্ষণের জন্য লবণাক্ত পানির বরফ ব্যবহার করা হয়। কখনো চিংড়ি বাছাই ও ওজন নেওয়া দ্রুত সম্ভব না হলে এ ধরনের কক্ষে সংগৃহীত চিংড়ির সংরক্ষণ করা হয়।
ক্লোরিন মিশ্রিত পানিতে ধোয়া চিল রুমে সাময়িক সংরক্ষিত চিংড়ি পরবর্তীতে ক্লোরিন মিশ্রিত পানিতে (৫ থেকে ১০ পিপিএম) ধোয়া হয়। বর্তমানে অধিকাংশ চিংড়ি প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানায় চিংড়ি সংরক্ষণের জন্য সেন্ডো কীপ (sendo keep) পাউডার ব্যবহার করা হয়। ক্লোরিন মিশ্রিত পানির মাধ্যমে চিংড়িকে বিশুদ্ধ বা জীবাণুমুক্ত করা হয়ে থাকে।
বাছাইক্রত চিংড়ি পুনঃপরীক্ষা: চিংড়িকে ক্লোরিন মিশ্রিত পানিতে জীবাণুমুক্ত করার পর পুনরায় চিংড়িকে গ্রেড অনুসারে ওজন ও বাছাই করা হয়। এ সময় চিংড়ির উদরাংশের পাতলা পর্দা ও শ্লেষ্মা ভালভাবে পরিস্কার করা হয় এবং নির্দিষ্ট ওজন অনুসারে স্ত্রী ও পুরুষ আলাদাভাবে বরফ পানিতে ধোয়ার জন্য ছিদ্রযুক্ত টেবিলে রাখা হয়। বরফ পানিতে উত্তমরুপে ধোয়ার পর ড্রেসিং টেবিলে সাজানো হয়।
চিংড়ি ড্রেসিং ও হিমায়িতকরণ পদ্ধতি: চিংড়ি ড্রেসিং করার ক্ষেত্রে ৩০ সেমি. x ২০ সেমি. মাপের টিনের
ট্রেতে ৭০ সেমি. × ৭৫ সেমি. মাপের পলিথিন পেপার বিছানো হয়। অতঃপর বরফ ধোয়া চিংড়িগুলো লম্বালম্বিভাবে দু'টি সারিতে এমনভাবে সাজানো হয়, যাতে দু'টি সারির চিংড়ির লেজগুলো পরস্পর মুখোমুখি থাকে। পরবর্তী ধাপে ট্রে সমেত চিংড়িগুলো ৫ প্রকোষ্ট বা ৩ প্রকোষ্ঠ ট্রেতে রাখা হয় এবং পুনরায় বরফ মিশ্রিত পানি চিংড়ির উপর দেয়া হয়। ট্রেগুলো বরফের পানি দিয়ে পূর্ণ হলে পলিথিন পেপার ভাঁজ করে চিংড়ির প্যাকিং ব্লক তৈরি করা হয় এবং এয়ারব্লাস্ট ফ্রিজারের ধারণক্ষমতা অনুযায়ী সংরক্ষণ করা হয়। ফ্রিজারে সংরক্ষণের ক্ষেত্রে ৩ থেকে ৫ প্রকোষ্ঠ লম্বা ট্রে ব্যবহার করা হয়। এয়ারব্লাষ্ট ফ্রিজারে সাধারণত লম্বা ট্রের পরিবর্তে ছোট ট্রে ব্যবহার করা হয়। ফ্রিজারের চিংড়ি হিমায়িতকরণের ক্ষেত্রে তাপমাত্রা মাইনাস ৩৭ ডিগ্রি সে. থেকে মাইনাস ৪০ ডিগ্রি সে. এ রাখা হয়। এভাবে হিমায়িতকরণ প্রক্রিয়া ১২ থেকে ১৩ ঘন্টা চলমান থাকে।
গ. বাক্সে প্যাক করা
প্রক্রিয়াজাতকৃত চিংড়ি হিমায়িত করার পর বর্গাকৃতির চিংড়ির ব্লকগুলো দ্রুত পলিথিন ব্যাগে ভরে সিল করা হয় এবং পরবর্তী ধাপে পলিথিন ব্যাগগুলো মাস্টার কার্টুনে ঢোকানো হয়। মাস্টার কার্টুনে ২০ থেকে ৫০ কেজির অধিক চিংড়ির ব্লক করা হয় না এবং কার্টুনগুলো সিনথেটিক গজ দিয়ে প্যাক করা হয়। পরবর্তী ধাপে কার্টুনের উপর চিংড়ির নাম, ওজন, গ্রেড প্রভৃতি উল্লেখ করা হয়।
ঘ. হিমাগারে সংরক্ষণ করা
পরবর্তী ধাপে মাস্টার কার্টুনগুলো মাইনাস ২০ ডিগ্রি সে.-এর নিম্ন তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করা হয়। হিমাগারে এ অবস্থায় চিংড়ি বহুদিন সংরক্ষণ করা হয়।
আদিকাল থেকেই মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্য পরিবহণ করার জন্য বিভিন্ন ধরনের প্যাকিং ব্যবস্থা চালু রয়েছে। কাঠের বাক্স, চামড়া ও কাপড়ের ব্যাগ, মাটির পাত্র ও বান্ডিল তৈরির জন্য রশি ব্যবহার করা হয়। প্যাকিং করার উদ্দেশ্য হলো যথাযথ সংরক্ষণ, সুষ্ঠ পরিবহণ ও হ্যান্ডলিং-কে সহজতর করা ও সর্বোপরি পণ্যের সুরক্ষা নিশ্চিত করা। মৎস্য পণ্য পরিবহণ করার জন্য বর্তমানে ধাতুর তৈরি পাত্রের সাথে সাথে গ্লাস, কাগজ ও প্লাষ্টিক দ্বারা তৈরি পাত্র ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। প্যাকিং প্রযুক্তি উন্নয়নের জন্য নিম্নলিখিত বিষয়গুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ
ক) প্যাকিং প্রযুক্তি এমন হবে যাতে চর্বির জারণ বন্ধ হয়
খ) হিমায়িত মৎস্য পণ্য পানিমুক্ত করা বন্ধ করবে যাতে ফ্রোজেন অবস্থায় গঠন ঠিক থাকে।
গ) ব্যাক্টেরিয়া জনিত ও রাসায়নিক পচন বন্ধ করবে।
ঘ) চিংড়ি থেকে গন্ধ বের হওয়া বন্ধ করবে।
তাজা চিংড়ি প্যাকিং: তাজা চিংড়ি সাধারণত প্লাস্টিক বাক্স বা খাদযুক্ত বাক্সে প্যাকিং করা হয়। প্লাস্টিক বাক্স অধিক ব্যবহৃত হচ্ছে কারণ প্লাস্টিক বাক্স হালকা, শক্ত ও স্বাস্থ্যসম্মত। চিংড়ি বাক্স নির্বাচনের ক্ষেত্রে নিম্নলিখিত বিষয়াদি বিবেচনায় নেয়া উচিত-
ক) বাক্সের আকার এমন হবে যাতে নির্দিষ্ট পরিমাণ চিংড়ি রাখা যায়।
খ) চিংড়িতে পূর্ণ বাক্স যাতে খুব সহজেই পরিবহণ করা যায়।
গ) বাক্স ব্যবহারের পর সহজেই পরিষ্কার করা যায়।
ঘ) চিংড়ি থেতলে যাওয়া, পচন, পরিবেশ দূষণ ও ছোটখাটো চুরি থেকে রক্ষা পাবে।
ঙ) বাক্সের আকৃতি এমন হবে যাতে বাক্সের ভিতরের চিংড়ির পরিমাণ সহজেই নির্ণয় করা যায়।
চ) চিংড়ি সহজেই বিক্রয় কেন্দ্রে প্রদর্শন করা যায়।
ছ) যদি বরফ ব্যবহৃত হয় তবে বরফ গলিত পানি বের হওয়ার সুযোগ থাকতে হবে।
জ) সর্বোপরি বাক্স তৈরির উপকরণ সহজপ্রাপ্য ও কম দামী হতে হবে।
পাইকারী বিক্রয়ের ক্ষেত্রে প্যাকিং: এক্ষেত্রে তাজা মাছ ও ফ্লোজেন চিংড়ি প্যাকিং করা হয়। সাধারণত রেসিন করা কাগজের মন্ডের বাক্স ব্যবহৃত হয়। তবে ফাইবার বোর্ড বাক্স ও করুগেটেড বোর্ড কার্টুন বেশি ব্যবহৃত হয়, কারণ এগুলোর উপর পলিথিনে আবৃত থাকে। কোন কোন ক্ষেত্রে অধিক পূর্ণতার জন্য পলিস্টাইরিন লাইনিং ব্যবহৃত হয়।
ব্লক ফ্রোজেন প্যাকিং: এ পদ্ধতিতে চিংড়ি (খোলস ছাড়ানো) ফাইবার বোর্ড কার্টুন দিয়ে প্যাকেট করা হয়। সমস্ত প্যাকেটটি প্লেট ফ্রোজেন করা হয়। প্যাকেট শক্ত হওয়াতে পণ্যকে রক্ষা করে এবং শক্ত বৈশিষ্ট্যের কারণে ব্লক ফ্রোজেন প্যাক খুব সহজেই স্টোর ও পরিবহণ করা যায়। এ পদ্ধতির অসুবিধা হলো প্যাকেটের একটা চিংড়ি বের করতে হলে সমস্ত বরফ গলাতে হয়।
আইকিউএফ (Individual Quick Freezing - IQF): প্যাকেট করা বস্তুর বৈশিষ্ট্য হলো ফ্রোজেন, গ্রেজড ও পলিথিন দ্বারা আবৃত বাক্সে ভর্তি। এ পদ্ধতিটি খুব উপযোগী কারণ খুব সহজেই খুচরা বিক্রির জন্য নুতুনভাবে প্যাকেট করা যায়। সরবরাহকারীদের নিকটও খুব উপযোগী কারণ প্রয়োজন অনুযায়ী সরবরাহ করা যায়। আইকিউএফ পদ্ধতিতে খোলস ছাড়ানো চিংড়ি ও মাছ প্যাকেট করা হয়।
লেয়ারড প্যাক: পলিকোটেড ফাইবার বোর্ড বাক্স দ্বারা প্যাক করা হয়। ফিলেটগুলো পলিথিন লেয়ার দ্বারা পৃথক করা এবং প্রয়োজন অনুসারে ফিলেটগুলো আলাদা করা যায়। লেয়ারড প্যাক, আইকিউএফ প্যাকের চেয়ে গাদাগাদি করে রাখা, গুদামজাত করা ও পরিবহণ করা সহজ।
স্যাটার প্যাকিং: সাধারণত হোটেল ও রেস্তোরায় মৎস্যজাত পণ্যের এই প্যাকেটগুলো ব্যবহৃত হয়, কারণ সমস্ত প্যাক থেকে ডিফ্রোস্টিটিং ছাড়া ফিলেটগুলো আলাদা করা যায়।
সারণি: সচারচর ব্যবহৃত প্যাকিং পাত্রের বৈশিষ্ট্যসমূহ
বাগদা চিংড়ি পরিবহণের ক্ষেত্রে নিম্নলিখিত বিষয়গুলো বিবেচনায় রাখতে হবে-
ক) পরিবহণের সময় ও দূরত্ব অনুসারে প্রয়োজনীয় বরফ ব্যবহার করতে হবে, যাতে গন্তব্য স্থানে পৌছার পরও চিংড়ির গায়ে বরফ থাকে।
খ) হোগলার চাটাই, ছালার চটে মুড়িয়ে বাঁশ নির্মিত ঝুড়িতে ও বরফবিহীন অবস্থায় চিংড়ি পরিবহণ পরিহার করা।
গ) ইনসুলেটেড/ তাপ নিরোধক পাত্র বা প্লাস্টিকের ঝুড়িতে বরফ মিশ্রিত করে চিংড়ি পরিবহণের ব্যবস্থা
করা।
ঘ) পরিবহণকালে পাত্র বা বাক্সে চিংড়ি রাখার সময় খেয়াল রাখতে হবে যাতে উপরের চিংড়ির চাপে বা বাক্সের ভালা লাগাবার সময় অধিক চাপ না পড়ে। অধিক চাপে নিচের চিংড়ি তাড়াতাড়ি নষ্ট হয়ে যেতে পারে, কেননা চিংড়ির মাংসপেশী অন্যান্য উচ্চতর প্রাণীর চাইতে নরম।
ঙ) ডিপো থেকে পরিবহণের ভাড়া সাশ্রয়ের প্রতি অধিক গুরুত্ব না দিয়ে ট্রাকে বরফ সহকারে চাটাই বা ত্রিপল দিয়ে ঢেকে যতদ্রুত সম্ভব চিংড়ি কারখানায় স্থানান্তর করা।
চ) অপর্যাপ্ত ও নিম্নমানের বরফ ব্যবহার করে খোলা ট্রাকে স্তুপাকারে অধিক পরিমাণ চিংড়ি পরিবহণ না করা। পরিবহণে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার দিকে অধিক গুরুত্ব দিতে হবে।
ছ) চিংড়ি বোঝাই ট্রাকে চাটাই বা ত্রিপলের উপর ট্রাকের সাহায্যকারীরা অবাধে চলাফেরা করার ফলে চিংড়ি থেতলে যায়, নরম হয়, সতেজতা হারায় এবং পচনকারী অণুজীব দ্বারা সহজেই সংক্রমিত হয়। চাটাই বা ত্রিপলের উপর দিয়ে ট্রাকের সাহায্যকারীরা অবাধে চলাফেরা করতে না পারে সেদিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখা।